জাপানে গিয়েছিলাম ২০১২ সালে, শিল্পীদের একটি আবাসিক কর্মসূচিতে। জাপানের নামকরা শিল্পী, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনের অধ্যাপক কোহেই নাওয়ার আমন্ত্রণে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়ি, তৃতীয় বর্ষে। দুই মাস জাপানে ছিলাম।
বেশির ভাগ সময় কিয়োটোয় থাকলেও ঘুরে বেড়িয়েছি টোকিও, নারা, ওসাকা, নাওশিমা, ইনুশিমা, তেশিমা—এসব জায়গায়।
সেখানকার দুটি গল্প বলব আজ। 1 সারা দিন মাউন্ট খুরামা থেকে ঘুরে এসে কিয়োটোয় ফিরছি বিকেলের ট্রেনে। একটি স্টেশন থেকে প্রচুর যাত্রী উঠলেন, ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। পুরো কামরায় শুধু আমার পাশের একটি সিট খালি। দুই বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই, কেউই বসছেন না। আমার পাশে দুজন তরুণী দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, আর আমি বসে আছি, অস্বস্তি কাজ করছিল। জাপানে মেয়েদের জন্য সিট ছেড়ে দেওয়ার কালচার নেই, শুধু অসুস্থ আর বৃদ্ধদের জন্য আছে। কী করা উচিত, ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ভাবলাম, জাপানিদের মধ্যে এমন আচার না-ও থাকতে পারে; কিন্তু আমি তো জাপানি না, বাংলাদেশি।
আমার দেশে পুরুষেরা গাড়িতে মা-বোনদের জন্য বিনা বাক্য ব্যয়ে আসন ছেড়ে দেন, আমিও দেব। সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, প্লিজ,আপনারা বসুন। ওই দুই আপু আমার এহেন আচরণে যেন ভূত দেখলেন, দুজনেই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর দুজন দুই হাত জোড় করে আমাকে অনুরোধ করতে লাগলেন—আমিই যেন বসি, তাঁরা বসবেন না। তিনজনই দাঁড়িয়ে আছি, কেউই বসছি না। আশপাশের লোকজন তাকিয়ে আছেন, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, এই ভয়ে আমি দ্রুত কথা না বাড়িয়ে কামরার সামনের দিকে চলে এলাম। আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। ট্রেন থামল কাঙ্গেতসুকিয়ো স্টেশনে, নেমে হেঁটে যাচ্ছি।
হঠাৎ কী মনে করে পেছনে তাকালাম। দেখি, ট্রেনের একটি জানালা দিয়ে দুই জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমার সিটে বসে আছেন তাঁরা। আমার চোখ পড়তেই মাথা নুইয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন দূর থেকে, আমিও মাথা নোয়ালাম।এবার দ্বিতীয় ঘটনা টোকিও। সাবওয়েতে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। টোকিওর সাবওয়ে স্টেশনগুলো চার-পাঁচতলাবিশিষ্ট, মানে মাটির তলায় একটির নিচে আরেকটি স্টেশন। স্টেশনে নামলাম, এসকেলেটরে চড়ে ওপরে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমার সামনে একজন উঠলেন, হুইলচেয়ারে বসা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, দুই হাতে অনেক কসরত করে এসকেলেটরের রেলিং ধরে ওপরে উঠছেন। ভাবলাম, ওনাকে ধরে তুলে দিই। হঠাৎ হাত ফসকে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কিন্তু আবারও বিভ্রান্ত হলাম। কারণ, জাপানিরা সাধারণত মুখে না বললে কাউকে সহায়তা করেন না, সহায়তা নেনও না। তাঁর পেছনের সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইলাম, যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ধরতে পারি।
ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ এক হাত ছুটে গেল তাঁর, হুইলচেয়ার কাত হওয়ার আগেই ধরে ফেললাম তাঁকে। এরপর একদম ওপরে ওঠা পর্যন্ত ধরে রইলাম তাঁকে। শেষে স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় হাত নেড়ে হাসি দিয়ে বিদায় দিয়ে গেলেন তিনি। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। স্টেশনের বাইরে বাকি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, দূরে একজন বয়স্ক জাপানি নারী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হলো, তিনি আমাকে কিছু বলতে চান। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিতেই তিনি ছুটে এলেন। এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কন্নিচিউয়া, আনাতা ওয়া নিহংগো ওয়াকারি মাস কা?’ (শুভ দিন, তুমি কি জাপানি ভাষা বোঝো?)। আমি বললাম, অল্প বুঝি। তিনি প্রথমেই আমাকে যে কথাটা বললেন, তা হলো—তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? আমি বললাম, বাংলাদেশ! এরপর তিনি আমার নাম, আমি কী করি, কিসে পড়ি জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি একটু আগে যা যা করলে, আমি সব দেখেছি। থ্যাংকস আ লট ফর ইউর কাইন্ডনেস, আরিগাতো, আরিগাতো গুজাইমাসু।’
তখনই আমি বুঝতে পারলাম, কেন প্রথমেই তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। তিনি আমার মাঝে আমার দেশকে খুঁজে পেয়েছেন। আমি কোনো ব্যক্তি নই তাঁর কাছে; বরং আমিই আমার দেশ। ‘আমি একজন বাংলাদেশি’—এটুকু ভেবে কী এক অদ্ভুত অহংকার কাজ করছিল বুকের মাঝে তখন, বোঝানো যাবে না। আমি জানি না আমার সেদিনের ওই সামান্য একটি কাজে তিনি কী এত ‘কাইন্ডনেস’ খুঁজে পেয়েছিলেন; কিন্তু আমার দেশের প্রতি যে সম্মানটা তিনি দেখিয়েছিলেন, ভুলব না কোনো দিন।