আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:২৩ পিএম |  অনলাইন সংস্করণ

সর্বগ্রাসী হুন্ডির কবলে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতি

সর্বগ্রাসী হুন্ডির কবলে পড়েছে। শত চেষ্টা করেও এই অর্থনীতি খেকো হুন্ডির গায়ে না লাগানো যায় বিষাক্ত তীর- না লাগানো যায় বন্ধুকের গুলি। অনবরত গিলছে তো গিলছেই। এতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। কারণ এর ভীত বড় শক্ত এবং শেকড় বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। কী বলছেন সম্মানিত পাঠক- হুন্ডির পূর্বাপর কথা জানতে চাচ্ছেন? হাঁ হুন্ডির কথাই বলছি।  ঘোড়ার স্ত্রী লিঙ্গ যেমন ঘুড়ি, সেই রকম হুন্ডার স্ত্রী লিঙ্গ হুন্ডি, তা কিন্তু নয়।

গঠন প্রণালির দিক দিয়ে এটি সামান্য একটি অনানুষ্ঠানিক কাগজের টুকরা (বিনিময় বিল) বই আর কিছু নয়। কিন্তু ম্যাগনিচিউড অনেক বেশি। যাহোক, এতক্ষণ রূপকভাবে কথা বললেও এবার আসুন দেখা যাক হুন্ডি কী, কী তার প্রকৃতি এবং কেন আমাদের অর্থনীতিকে এত বড় ভয়াল থাবাতে জীর্ণশীর্ণ করে তুলেছে?

হুন্ডি (Hundi) বলতে সাধারণত নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে কিম্বা অননুমোদিত চ্যানেলে বিভিন্ন কৌশল ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ আনয়ন বা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। হুন্ডি হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা মধ্যযুগীয় ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনে ব্যবহারের জন্য উদ্ভূত হয়েছিল। সাধারণত হুন্ডি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ প্রেরণের জন্য রেমিট্যান্স পদ্ধতির একটি মাধ্যম, যা ক্রেডিট উপকরণ হিসেবে অর্থ দেনা-পাওনা বা IOU এবং যুগপৎ বাণিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে বিনিময় বিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা হয়

metafore online

আসলে হুন্ডির মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয় হুন্ডির কার্যক্রম প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে

একটা সময়ে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ। এখনো তা নিরাপদ, তবে বৈধ না। অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সিল্ক রুটে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। ডাকাতির ভয়ে তখন নগদ অর্থ বা মূল্যবান কিছু বহন করা নিরাপদ ছিল না। আর সেই সময় থেকেই হুন্ডির প্রসার। বস্তুত হুন্ডি বা হাওয়ালা একই প্রপঞ্চ। হাওয়ালা কথাটা এসেছে আরবি থেকে। আর হুন্ডি এসেছে সংস্কৃতি হুন্ড শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো সংগ্রহ করা। হুন্ডি কথাটি আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়। আর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতে হাওয়ালা কথাটা প্রচলিত এবং এর অর্থ হচ্ছে লেনদেন বা কোনো কিছু পাঠানো।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সে সময়ে ভারত উপমহাদেশের লোক এতটাই সরল ও খোলামেলা ছিল যে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন অপরিচিত ব্যক্তি কোনো সররাফের (কথিত ব্যাংক) কাছে সাক্ষী ছাড়া অর্থ জমা দিতে দ্বিধাবোধ করত না। অবশ্য এক্ষেত্রে সিলমোহর ও খাম ছাড়া শুধু একটি চিরকুট পেত। আর পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি আবার দূরে কোনো তার চাহিদা মতো স্থানে সররাফের কর্মচারী গোমস্তা বা এজেন্টের কাছে ওই চিরকুট উপস্থাপন করলে কোনো বাক-বিতণ্ডা বা ঢিলেমি ছাড়াই অতি সহজে টাকা হাতে পেয়ে যেত। আসলে এদেশে এটিই হুন্ডির অন্যতম আদি কথা। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, হুন্ডি মোগল অর্থনীতির অধীনে বিকশিত একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ লেনদেন পত্র। মূলত হুন্ডি বলতে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আর্থিক দলিল। অর্থ প্রেরণের উপায়, ঋণ প্রদান এবং বাণিজ্যিক লেনদেনে বিনিময় বিল হিসেবে হুন্ডি ব্যবহৃত হতো।

কৌশলগত দিক দিয়ে এটি হলো এমন একটি লিখিত শর্তহীন আদেশ যা এক ব্যক্তির নির্দেশ অনুযায়ী অন্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়

এই হুন্ডি অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অংশ হওয়ার কারণে এই আইনগত কোনো অবস্থান নেই। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ১৭ শতকে বাংলা থেকে দিল্লিতে ভূমি রাজস্ব বা খাজনা পাঠানো হতো কফিল অথবা গরুর গাড়ির মাধ্যমে। এ পদ্ধতি ছিল একদিকে ব্যয়বহুল এবং অন্যদিকে অনিরাপদ। Bd news Bangla এতদ্বতীত রাজকীয় অর্থ পাঠানোর কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে মুদ্রার সংকট দেখা দিত। আর এই কারণে সেই সময়েই হুন্ডির বাজার বিকশিত হয়। মজার ব্যাপার হলো, হুন্ডি ব্যবস্থা শুধু মুদ্রা অর্থনীতির উত্থানেই অবদান রাখেনি। বরং সামরিক অভিযান ও দূরবর্তী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তাছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সু-সম্পর্ক স্থাপন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

এক্ষেত্রে ইউরোপের উপকূলবর্তী প্রায় সব দেশের বণিকরা যখন এ উপমহাদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আসে। তখন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পর হুন্ডি ব্যবস্থা তাদের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রকাশ থাকে যে মোঘল আমলের পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে জগৎ শেঠ ও মাহতাব চাঁদের হুন্ডি গৃহ সর্বজন বিদিত ছিল।

১৮ শতকের শেষার্ধে বাংলায় আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ১৯ শতকের প্রথমার্ধে হুন্ডি ব্যবস্থার ততটা গুরুত্ব থাকে না

clipping path tech

তবে একসময় যে হুন্ডি ছিল নিরাপদ অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা, সেটাই এখন অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা। প্রকাশ থাকে, ঔপনিবেশিক আমলে, ব্রিটিশ সরকার হুন্ডি প্রথাকে আদিবাসী বা ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করত, তবে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। এমনকি তারা এতে হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক ছিল কারণ এটি ভারতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল এবং তারা এই ব্যবস্থার অধীনে লেনদেনের ওপর কর পর্যন্ত আরোপ করতে চেয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, সরকারি হুন্ডিগুলো রানি ভিক্টোরিয়াসহ ব্রিটিশ রাজাদের ছবি সমেত রাজস্ব স্ট্যাম্প যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধের কারণে প্রায় সময়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হতো। তাই অনেক সময় এই ব্যবস্থাটি লুকোচুরির আওতায় সম্পাদন হতো। হুন্ডি অনেক প্রকারের। তবে বহুল ব্যবহৃত হুন্ডি দুই প্রকারের। যেমন : ১. দর্শনি হুন্ডি এবং ২. মুদ্দাতি হুন্ডি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, দর্শনি হুন্ডি দৃশ্যমান, যা সচারচর চোখে পড়ে এবং এটি প্রাপ্তির পরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ প্রদান করতে হয়, যা চাহিদা বিলের অনুরূপ। অন্যদিকে মুদ্দাতি হুন্ডি টাইম বিলের মতো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে দিতে হয়।

সম্পর্কিত খবর

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version