আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫: ২৩ |  অনলাইন সংস্করণ    হাতাতে ভিসেরা প্রতিবেদনে 

ব্যাংক কর্মকর্তার অর্থ হাতাতে ভিসেরা প্রতিবেদনে ‘জালিয়াতি’, অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

হাতাতে ভিসেরা প্রতিবেদনে

গাজীপুরে অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতি করে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে তদন্ত কর্মকর্তাসহ কয়েক ব্যক্তির বিরুদ্ধে।

আদালতে দেওয়া প্রথম ভিসেরা প্রতিবেদনে বিষের আলামত পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে পরে ‘প্রকৃত ভিসেরা প্রতিবেদনে’ ওই ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহে বিষের অস্তিত্বের উল্লেখ করা হয়নি।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমানের আদালতে দুই দফায় জমা দেওয়া ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। গাজীপুর আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। ওই ব্যাংক কর্মকর্তার নাম গিয়াস উদ্দিন খান। তিনি সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন, থাকতেন গাজীপুর সদরের বরুদা এলাকায়। ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ মারা যান তিনি। স্ত্রী-সন্তানেরা এ মৃত্যুর কারণ হৃদ্‌রোগ বললেও গিয়াসের ছোট ভাই বশীর আহম্মেদ খান হত্যা মামলা করেন।

clipping path tech

এতে আসামি করা হয় গিয়াসের স্ত্রী–সন্তান ও আত্মীয়দের। মামলায় অভিযোগ করা হয়, গিয়াসের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করতে তাঁকে মারধরসহ শরীরে বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম, দুই সন্তান সোহেলী নাজনীন ও শাহরিয়ার শুভ, জাহানারার ভাই আক্তার হোসেন ও বোন পারভীন আক্তার। এ হত্যা মামলা প্রথমে জয়দেবপুর থানার পুলিশ তদন্ত করে। পরে তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআইয়ের গাজীপুর জেলার পরিদর্শক হাফিজুর রহমান। বর্তমানে তিনি বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কর্মরত। এ হত্যা মামলায় গিয়াসের স্ত্রী, দুই সন্তান, শ্যালক ও শ্যালিকাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন।হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রথম আলোকে বলেন জাহানারা বেগম। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করতে তাঁদের হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন গিয়াসের ছোট দুই ভাই বশীর আহম্মেদ খান ও ফরিদ আহম্মেদ খান। ফরিদ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী পুলিশ সুপার। তিনি ঢাকায় মালিবাগ প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।

জাহানারা ও তাঁর আইনজীবী এম হেদায়েত উল্লাহ চৌধুরীর অভিযোগ, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান এবং ময়নাতদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাকে দিয়ে ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মেদ খান।

২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জালিয়াতি করা ভিসেরা প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে বলা হয়, গিয়াসকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। আইনজীবী হেদায়েত উল্লাহ জানান, সে সময় তিনি আদালতকে বলেন, ওই প্রতিবেদন সঠিক নয়। আদালত পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুরকে আদালতে তলব করে এর ব্যাখ্যা চান। পরে ২০১৭ সালের ১৪ জুন আরেকটি ভিসেরা প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন হাফিজুর রহমান। এই ভিসেরা প্রতিবেদনকে তিনি ‘প্রকৃত ভিসেরা প্রতিবেদন’ বলে উল্লেখ করেন।

দ্বিতীয় এ ভিসেরা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গিয়াসের মরদেহে বিষ পাওয়া যায়নি। কোনো ব্যক্তির মৃত্যু বিষক্রিয়ায় হয়েছে কি না, তা নির্ণয়ে ভিসেরা পরীক্ষা করা হয়। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গিয়াসের মরদেহের ময়নাতদন্তের সময় তাঁর পাকস্থলীর ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে এবং কিডনি ও লিভারের হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল।চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে জাহানারা বেগম ভিসেরা প্রতিবেদন জালিয়াতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে এসবির সহকারী পুলিশ সুপার ফরিদ আহম্মেদ খান এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরের ‘আইজিপি’স কমপ্লেইন মনিটরিং সেল’–এ লিখিত আবেদন করেন। এ আবেদনের অনুলিপি তিনি এসবির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের কাছেও দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতির দায় এড়াতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নে পিবিআইয়ের তৎকালীন পরিদর্শক হাফিজুর রহমান গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতি হয়েছে, তবে এর সঙ্গে তিনি জড়িত নন।হাফিজুর রহমান বলেন, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুস সালাম সরকারের মাধ্যমে তিনি ভিসেরা প্রতিবেদন পেয়েছিলেন এবং সেটাই আদালতে জমা দেন।

এ বিষয়ে আবদুস সালাম ভালো বলতে পারবেন। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি একাধিকবার তদন্তও করেছে।

আবদুস সালাম সরকার বর্তমানে গাজীপুরে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) অধ্যক্ষ। এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে খামে আসা প্রতিবেদন তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতি হলে রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।ভিসেরা প্রতিবেদন জালিয়াতিতে প্রভাব খাটানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় গিয়াস উদ্দিনের ভাই এসবির সহকারী পুলিশ সুপার ফরিদ আহম্মেদ খানের কাছে।

metafore online

তিনি বলেন, ভিসেরা প্রতিবেদন জালিয়াতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জড়িত থাকতে পারে। এ জালিয়াতিতে ব্যক্তি হিসেবে তাঁর জড়িত থাকার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।জাহানারার আইনজীবী হেদায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, গত সেপ্টেম্বরে আদালতের নজরে আনার পর তিনি গিয়াসের ভিসেরা প্রতিবেদন চেয়ে মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে আবেদন করেন। তবে তাঁকে ভিসেরা প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। পরে জাহানারার পক্ষে তিনি প্রকৃত ভিসেরা প্রতিবেদন পেতে তথ্য কমিশনে আবেদন করেন।

আইনজীবী হেদায়েত উল্লাহ জানান, তথ্য কমিশনের শুনানিতে মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরীক্ষক দিলীপ কুমার সাহা বলেন, গিয়াসের মরদেহে বিষ পাওয়া যায়নি। ওই ভিসেরা প্রতিবেদনে জালজালিয়াতি করা হয়েছে। পরে তিনি ২০১৭ সালের ১১ জুন প্রকৃত ভিসেরা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেন। সেই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। জানতে চাইলে মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরীক্ষক দিলীপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ভিসেরা প্রতিবেদনে জালিয়াতি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে থাকা স্বাক্ষর তাঁর নয়।

সম্পর্কিত খবর:

‘বোমা বানাতে’ গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু, পুলিশের ‘গাফিলতিতে’ আলামত নষ্ট

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version