প্রকাশিত : অক্টোবর ১২, ২০২৩, ১৬:০৪ পিএম | অনলাইন সংস্করণ মৃত্যুপুরী গাজার
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান বিমান হামলায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না হাসপাতাল, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসামরিক নাগরিকদের বাসা-বাড়িও। গত ২৯ দিনের যুদ্ধে গাজা উপত্যকায় ৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৯০০ জনের বেশি শিশু।
এর মাঝেই শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করেছে। এতে দেখা যায়, গাজা উপত্যকার দক্ষিণের দিকে চলে যাওয়া একটি রাস্তায় একের পর এক লাশ পড়ে আছে। রয়টার্স বলছে, অন্তত সাতজনের মরদেহ ওই সড়কে পড়ে আছে। গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে বর্তমানে স্থল হামলা পরিচালনা করছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। স্থল হামলার পাশাপাশি বিমান ও সমুদ্র থেকেও গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় প্রতিদিন শত শত ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটছে।
গাজা শহর থেকে দক্ষিণের ওয়াদির মধ্যবর্তী আল-রশিদ উপকূলীয় সড়কে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে বলে রয়টার্স নিশ্চিত হয়েছে। রয়টার্স তাৎক্ষণিকভাবে ভিডিওটি ধারণের তারিখ যাচাই করতে পারেনি। তবে ভিডিওটি যে শুক্রবারের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি সেটি নিশ্চিত হয়েছে রয়টার্স।
একই সাথে ভিডিওটি ধারণ করা ব্যক্তির পরিচয় কিংবা ভিডিওতে যাদের মরদেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে তাদের পরিচয়ও যাচাই করতে পারেনি ব্রিটিশ এই বার্তা সংস্থা। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এই ভিডিওর বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
ভিডিওতে কিছু ধ্বংসাবশেষ এবং অনেকের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র মরদেহের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। নিহতদের অন্তত একজন শিশু। রাস্তায় রক্তের দাগও রয়েছে। রয়টার্স বলছে, কোনও ব্যক্তি বা কিশোর ভিডিওটি রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় ধারণ করেছে। ভিডিও ধারণের সময় তাকে কথা বলতে ও কান্না করতেও শোনা যায়। একপর্যায়ে তার পেছনে সাইকেলে থাকা আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায়।
সাইকেল আরোহীকে আরবিতে বলতে শোনা যায়, ‘‘আল্লাহ, একটি শিশুর মরদেহ। আল্লাহ, নারী ও তরুণীর মরদেহ। আল্লাহ আমাদের লোকজনদের রক্ষা করুন।
ইসরায়েল বলছে, গাজার উত্তর উপত্যকাকে দক্ষিণ উপত্যকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাদের সামরিক বাহিনী।
বর্তমানে গাজা নগরীকে পুরোপুরি ঘিরে অভিযান পরিচালনা করছে ইসরায়েলি সৈন্যরা। গাজা ওয়াদির কাছের সড়ক কেটে মূল শহরকে দক্ষিণ গাজা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা শুরু করা গাজার ক্ষমতাসীন সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূলের লক্ষ্যে উপত্যকাজুড়ে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের হামলায় উপত্যকায় এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে।
আর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন এক হাজার ৫০০ জনের বেশি। ইসরায়েলে হামলা চালানোর দিন (৭ অক্টোবর) ২৪২ জনের বেশি ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে ধরে নিয়ে জিম্মি করেছে হামাস। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এই জিম্মিদের অন্তত ৫০ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে গোষ্ঠীটি। রয়টার্স বলছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর আল্টিমেটামের পর গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন অনেকে।
বেসামরিক নাগরিকদের উত্তরাঞ্চল থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও পথে ইসরায়েলি বাহিনী বোমাবর্ষণ করছে।
ইসরায়েলের হামলার মুখে গৃহহীন হওয়া আরও ৪৫ জনের সঙ্গে একটি ভবনের মাটির নিচের তলায় আশ্রয় নিয়েছেন গাজার বাসিন্দা কামাল মাশাহারাবি। তিনি বলেন, ‘খুবই কঠিন একসময় পার করছি আমরা। পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট নেই। সাধারণ মানুষের এভাবে মৃত্যু হতে পারে না। তাঁদের এই সংঘাতের বাইরে রাখা উচিত।’ আগে থেকেই গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দা ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
জাতিসংঘ গতকাল জানায়, শনিবার হামলা শুরুর পর পর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কাছে তারা ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে পারছে না। জাতিসংঘের হিসাবে, ইসরায়েলের হামলার মধ্যে গাজায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা গতকাল জানায়, গাজায় তাঁদের খাবার ও পানির যে মজুত আছে, তা দিয়ে ১২ দিনের মতো ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে গাজায় মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি গতকাল বলেছেন, ‘গাজায় অবশ্যই খাবার, পানি, জ্বালানিসহ জরুরি জীবনরক্ষাকারী পণ্য যেতে দিতে হবে।
আমাদের এখন দ্রুত ও নির্বিঘ্ন মানবিক সহায়তা প্রদানের সুযোগ পেতে হবে।’ গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মিসর।
এ জন্য জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও হামাস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। স্বাস্থ্যসেবার করুণ দশা ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা গতকাল বলেন, গাজায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানির যে মজুত আছে, তা দিয়ে আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত চলা সম্ভব।
এর পর থেকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। গাজার বাসিন্দাদের জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেছেন, দ্রুত ওষুধসহ চিকিৎসাসামগ্রী না পেলে শত শত মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে না। গাজা সিটির আল-ওয়াফা হাসপাতালের চিকিৎসক হাসান খালাফ বললেন, হতাহত ব্যক্তি ছাড়াও হাসপাতালটিতে এখন শতাধিক নবজাতক রয়েছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে এসব শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ, তাদের জীবন এখন পুরোটাই নির্ভর করছে বিদ্যুৎ আর চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর। পরিবারের কেউ বেঁচে নেই গাজার বাসিন্দা আলা আল-কাফারনেহ।
ইসরায়েলে হামলায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে পরিবারের আট সদস্যের সবাইকে হারিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও আছেন। গাজার উত্তর-পূর্ব দিকের ছোট্ট শহর বেইত হানুনের বাসিন্দা কাফারনেহ বলেন, ‘ভোররাত চারটার দিকে আমরা যেখানে থাকি, সেই ভবনে বোমা হামলা হয়। আমরা জানি না কেন আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। আমরা তো কিছুই গত সোমবার রাতে হঠাৎ প্রতিবেশীদের ‘পালাও পালাও’ চিৎকার শুনতে পান গাজার বাসিন্দা নাদিয়া। তিন মাস ও পাঁচ বছর বয়সী দুই সন্তান রয়েছে তাঁর।
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে দুই সন্তানকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়ে পালান নাদিয়া। দুই দিন পর ফিরে দেখেন পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বোমা হামলায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তাঁর বাড়ি। নাদিয়া বলেন, ‘মৃত্যু যখন আকাশ থেকে আপনাকে তাড়া করে ফেরে, তখন আপনি পালিয়ে আর যাবেন কোথায়?’
সূত্র: রয়টার্স, টাইমস অব ইসরায়েল।
সম্পর্কিত খবর
ভিডিও: লেবাননে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
টাইম ম্যাগাজিনের সেরা উদ্ভাবনের তালিকায় ‘অপো জিরো-পাওয়ার ট্যাগ’