প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২: ২১ |  অনলাইন সংস্করণ    তদন্তের পর সাক্ষ্য

দায়সারা তদন্তের পর সাক্ষ্য দেননি কর্মকর্তা, মাদক মামলার আসামি খালাস

তদন্তের পর সাক্ষ্য

যে চক্রের মাধ্যমে রাজধানীতে ভয়ংকর মাদক আইস ব্যাপকভাবে মাদকসেবীদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে, সেই চক্রের অন্যতম সদস্য তারেক আহম্মেদ। দুই বছর আগে আইসসহ তাঁকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। কিন্তু এ–সংক্রান্ত মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন তারেক। নথিপত্র বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দায়সারা তদন্ত করে মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এরপর বিচার চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাননি। ফলে আসামি খালাস পেয়েছেন। এই মামলার মোট সাক্ষী সাতজন।

তাঁদের মধ্য পাঁচজন ডিএনসির সদস্য, বাকি দুজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত দুই সাধারণ ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মির্জা মো. মনিরুজ্জামান, এএসআই আজাদ হোসেন ও সিপাহি মুহাম্মদ আছাদুর রহমান এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত দুজন মো. কাইয়ূম ও কাউছার আহম্মেদ আদালতে সাক্ষ্য দেননি। সাক্ষ্য দিয়েছেন কেবল মামলার বাদী এসআই সাজ্জাদ হোসেন ও এএসআই জিয়াউর রহমান।মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার বারিধারার দূতাবাস সড়কের ২০ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তারেক আহম্মেদকে আটক করা হয়। এ সময় তাঁর কক্ষ থেকে ৫ গ্রাম আইস উদ্ধার করা হয়।

clipping path tech

তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গ্যারেজে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় ১০০টি ইয়াবা।

এ ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা করেন ডিএনসির এসআই সাজ্জাদ হোসেন। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র জমা দেন ডিএনসির এসআই মির্জা মো. মনিরুজ্জামান। অভিযোগপত্রে তারেক আহম্মেদ একমাত্র আসামি। বিচার কাজ শেষে চলতি বছরের ৬ মার্চ মামলার রায় দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। রায়ে আসামি তারেক খালাস পান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় সাক্ষ্য না দেওয়ায় আসামি খালাস পেয়েছেন, এমন তথ্য তিনি জানেন না। তবে কোনো কর্মকর্তা মামলায় সাক্ষ্য না দিলে আসামি যদি খালাস পায়, তবে অবশ্যই সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান তিনি।তারেক আহম্মেদকে গ্রেপ্তারের পর ডিএনসি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, ২০২১ সালের ২১ আগস্ট বনানী ও উত্তরা থেকে ৫০০ গ্রাম আইসসহ একটি চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান, ভাটারা, কুড়িল ও রমনা এলাকায় অভিযান চালায় ডিএনসি। ওই অভিযানে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের একজন হচ্ছেন তারেক আহম্মেদ। তাঁদের কাছ থেকে ৫৬০ গ্রাম আইস ও ১ হাজার ২০০টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এ ঘটনায় তারেক আহম্মেদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তাতে ধারাবাহিক অভিযানের কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় তারেকের কোনো সহযোগীর নামও বলা হয়নি। অথচ তারেককে গ্রেপ্তারের ১৯ দিন আগে তাঁর ১০ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আবার তাঁকে গ্রেপ্তারের দিনও চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্তে মাদকের উৎস, গন্তব্য, প্রেরক, প্রাপক এবং সহযোগীরা কারা—এসব বিষয় উঠে আসেনি। এজাহারের বক্তব্যই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিএনসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মাদক মামলার অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যান ঠিকমতো এজাহার দায়ের ও তদন্ত না হওয়ার কারণে। তারেক আহম্মেদের বিরুদ্ধে যেভাবে এজাহার দায়ের ও তদন্ত করা হয়েছে পুরোটাই দায়সারা। এই মামলায় সাক্ষ্য না দেওয়া তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগেও অনেক মামলায় সাক্ষ্য না দেওয়ার অভিযোগ আছে। আসামিপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করেই মূলত তারা সাক্ষ্য দেন না বলেও বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে। দায়সারা তদন্তের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসির এসআই মির্জা মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তদন্তে যা পেয়েছেন, সেটিই উল্লেখ করেছেন। তবে অনেক দিন আগে অভিযোগপত্র দিয়েছেন, কী উল্লেখ করেছেন, এ বিষয়ে কিছু তাঁর মনে নেই। মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তারিখ ধার্য করার পর আদালত সমন জারি করেন। সেই সমন পেয়ে নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন।

কিন্তু এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মির্জা মনিরুজ্জামান দাবি করেন, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সমন পেয়েছেন কি না, বা তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন কি না, সেটা তিনি মনে করতে পারছেন না। বেকসুর খালাস, আপিল করেনি কর্তৃপক্ষ মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উল্লিখিত পাঁচ সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সর্বশেষ গত ৩ মার্চ আদালতে দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন কোনো সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় আসামিপক্ষের আইনজীবী মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত করার আবেদন জানিয়ে বলেন, এই মামলায় দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য এর আগে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এরপর অন্যদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য একাধিক তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত আসামিপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করেন এবং ৬ মার্চ রায়ের দিন ধার্য করেন। রায়ে বলা হয়, তারেক আহম্মেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে অভিযোগের দায় থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

metafore online

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, আপিল করার এখতিয়ার তাঁর নেই।

যদি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আপিল করার প্রয়োজন মনে করে, তবেই আপিল করার সুযোগ আছে। এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মাদক মামলায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি সাক্ষ্য না দেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে অপরাধীর যোগসূত্র থাকতে পারে।

কেন তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাক্ষ্য দিলেন না, সেটি তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।জানা গেছে, আইস ইয়াবার চেয়ে ক্ষতিকর। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, স্বচ্ছ কাচের (ক্রিস্টাল) মতো দেখতে এই মাদক সেবনে নিদ্রাহীনতা, স্মৃতিবিভ্রম, মস্তিষ্কবিকৃতিসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি সেবনে ওজন হারানো, কিডনি ও হৃদ্‌ন্ত্রের সমস্যা এবং বিষণ্ণতা, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

সম্পর্কিত খবর:

জট না খোলা হত্যা মামলার নথি সংরক্ষণ থাকবে ৩০ বছর

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version